যে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ইলেকট্রনের দান ঘটে তাকে জারণ বিক্রিয়া এবং যে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ইলেকট্রনের গ্রহণ ঘটে তাকে বিজারণ বিক্রিয়া বলা হয়। আবার যে পদার্থ ইলেকট্রন ত্যাগ করে তাদেরকে বিজারক এবং যে পদার্থ ইলেকট্রন গ্রহণ করে তাদেরকে জারক পদার্থ বলে। জারণ- বিজারণ বিক্রিয়া একই সাথে সংঘটিত হয়। তাই জারন বিজারণ একটি যুগপৎ বিক্রিয়া।
জারণ অর্ধবিক্রিয়াঃ Na° → Na + e
বিজারণ অর্ধবিক্রিয়াঃ Cl° + e = Cl
এই দুই অর্থ বিক্রিয়াকে যোগ করলে জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া পাওয়া
জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া: Na° + CI° = Na + Cl
এখানে স্পষ্টত জারণে বিজারক পদার্থ ইলেকট্রন ত্যাগ করেছে, অপরদিকে বিজারণে জারক পদার্থ ঐ ইলেকট্রন গ্রহণ করেছে। যদি জারক পদার্থ ।ইলেকট্রন গ্রহণ না করত তাহলে বিজারক পদার্থ Na ইলেকট্রন দান করতে পারত না। কাজেই বলা যায় জারণ যখনই ঘটবে সাথে সাথে সেখানে বিজারণও ঘটবে। অর্থাৎ জারণ-বিজারণ একটি যুগপৎ প্রক্রিয়া (Simultaneous Process)
যেহেতু বিজারক ইলেকট্রন দান করে এবং জারক উক্ত ইলেকট্রন গ্রহণ করে কাজেই বলা যায় জারণ- বিজারণ বিক্রিয়া মানেই ইলেকট্রন স্থানান্তর প্রক্রিয়া।
বেশ কিছু বিক্রিয়া আছে যেখানে জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া ঘটে। সেগুলো হচ্ছে:
1. সংযোজন বিক্রিয়া
2. বিয়োজন বিক্রিয়া
3. প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া
4. দহন বিক্রিয়া
1. সংযোজন বিক্রিয়া (Addition Reaction):
যে জারণ বিজারণ বিক্রিয়ায় দুই বা ততোধিক রাসায়নিক পদার্থ পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে একটিমাত্র উৎপাদ উৎপন্ন করে তাকে সংযোজন বিক্রিয়া বলে। যেমন। ফেরাস ক্লোরাইডের সাথে ক্লোরিন যুক্ত হয়ে ফেরিক ক্লোরাইড উৎপন্ন করে।
2FeCl + Cl2 = FeCl3 (aq)
আবার, হাইড্রোজেন গ্যাস নাইট্রোজেন গ্যাসের সাথে যুক্ত হয়ে অ্যামোনিয়া গ্যাস উৎপন্ন করে। এটিও সংযোজন বিক্রিয়ার উদাহরণ।
N2 +3H = 2NH3
তবে যেসব সংযোজন বিক্রিয়ায় শুধু মৌলিক পদার্থ যুক্ত হয়ে যৌগ গঠন করে, তাদেরকে সংশ্লেষণ বিক্রিয়াও বলে। সুতরাং অ্যামোনিয়া গ্যাস উৎপন্ন করার বিক্রিয়াটি একাধারে সংযোজন বা সংশ্লেষণ বিক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত।
2. বিয়োজন বিক্রিয়া (Decomposition Reaction):
যে বিক্রিয়ায় একটি যৌগ ভেঙে একাধিক যৌগ বা মৌলে পরিণত হয় তাকে বিয়োজন বিক্রিয়া বলা হয়। যেমন: ফসফরাস পেন্টাক্লোরাইডকে তাপ দিলে তা বিয়োজিত হয়ে ফসফরাস ট্রাইক্লোরাইড ও ক্লোরিন উৎপন্ন করে। এটি বিয়োজন বিক্রিয়া।
আবার, পানিকে তড়িৎ বিশ্লেষণ করলে একটি অণু ভেঙে দুটি অণুতে পরিণত হয়। অ্যানোডে অক্সিজেন গ্যাস ও ক্যাথোডে হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। এটিও বিয়োজন বিক্রিয়ার উদাহারণ:
PCl5 = PCl3 + Cl2
3. প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া (Substitution or Displacement Reaction)
কোনো অধিক সক্রিয় মৌল বা যৌগমূলক অপর কোনো কম সক্রিয় মৌল বা যৌগমূলককে প্রতিস্থাপন করে নতুন যৌগ উৎপন্ন করার প্রক্রিয়াকে প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া বলে।যেমন: জিংক ধাতু সালফিউরিক এসিডের হাইড্রোজেনকে প্রতিস্থাপিত করে জিংক সালফেট ও হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন করে। এটি প্রতিস্থাপন বিক্রিয়ার উদাহারণ:
Zn(s) + H2SO4 = ZnSO4 + H2 (g)
4. দহন বিক্রিয়া (Combustion Reaction)
কোনো মৌল বা যৌগকে বাতাসের অক্সিজেনের উপস্থিতিতে পুড়িয়ে তার উপাদান মৌলের অক্সাইডে পরিণত করার প্রক্রিয়াকে দহন বিক্রিয়া বলে। দহন বিক্রিয়ায় সব সময় তাপ উৎপন্ন হয়। এই প্রক্রিয়ায় ইলেকট্রন এর আদান প্রদান ঘটে। যেমন: প্রাকৃতিক নাসে বা মিখেন বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়ায় করে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও পানি উৎপন্ন করে। এটি দহন বিক্রিয়ার উদাহরণ।
CH4 + 2O2 = CO2 (g) + 2H2O (g)
একইভাবে S. C. Mg ও H2 কে দহন করলে তাদের অক্সাইড উৎপন্ন হয় এবং তাপ উৎপন্ন হয়।
দহন বিক্রিয়ার প্রতিক্ষেত্রেই অক্সিজেন ইলেকট্রন গ্রহণ করে অপর যৌগ বা মৌল ইলেকট্রন ত্যাগ করে। সুতরাং দহন বিক্রিয়া জারণ-বিজারণ বিক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত।
★ নন-রেডক্স (Non Redox) বিক্রিয়া
অনেক রাসায়নিক বিক্রিয়া দেখা যায় যেখানে ইলেকট্রনের আদান-প্রদান ঘটে না। এ ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়াকে নন-রেডক্স বিক্রিয়া বলে। এ ধরনের বিক্রিয়ায় যেহেতু ইলেকট্রনের আদান- প্রদান ঘটে না সুতরাং বিক্রিয়ায় কোনো পরমাণুর জারণ সংখ্যার হ্রাস বা বৃদ্ধি ঘটে না। নিম্নে বিভিন্ন প্রকার দিন-রেডক্স বিক্রিয়া দেখানো হলো যেমন:
(1) প্রশমন বিক্রিয়া
(2) অধঃক্ষেপণ বিক্রিয়া ইত্যাদি।
1. প্রশমন বিক্রিয়া (Neutralization Reaction):
একটি এসিড ও একটি ক্ষার পরুপরের সাথে বিক্রিয়া করে প্রশমিত হয়ে লবণ ও পানি উৎপন্ন করে। এই বিক্রিয়াকে প্রশমন বিক্রিয়া বলা হয়। এ
ধরণের বিক্রিয়াকে এসিড ক্ষার বিক্রিয়াও বলা হয়। যেমন:
HCI ও NaOH পরস্পরের সাথে বিক্রিয়া করে NaCl লবণ ও পানি উৎপন্ন করে। এটি একটি প্রশমন বিক্রিয়া। একে এভাবে দেখানো যায়:
HCl(aq) + NaOH(aq) = NaCl(aq) + H₂0(l)।
প্রশমন বিক্রিয়ায় সর্বদাই তাপ উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ প্রশমন বিক্রিয়া তাপোৎপাদী বিক্রিয়া এবং এসিড ও ক্ষার উভয়ই তীব্র হলে এই তাপের মান হয় AH-57.34 kJ । প্রশমন বিক্রিয়ায় এসিড হাইড্রোজেন আয়ন (H`) সরবরাহ করে এবং ক্ষার হাইড্রোক্সাইড আয়ন (OH) সরবরাহ করে। তারপর উন্ত আয়ন দুটি পরস্পরের সাথে বিক্রিয়া করে পানি উৎপন্ন করে। NaCl জলীয় দ্রবণে Na+
এবং Cl- আয়ন হিসেবে থাকে।
H+CI+Na+ OH NaCl+H₂O
এই দ্রবণে উপস্থিত Na+ ও Cl- আয়নদ্বয়, বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না। এদেরকে দর্শক আয়ন বলে । প্রশমন বিক্রিয়ার প্রকৃত সমীকরণ হলো:
H + OH = H₂O + 57.34 kJ
সুতরাং প্রশমন বিক্রিয়া বলতে আমরা H+ আয়ন ও OH- আয়নের সহযোগে পানি উৎপন্ন করার বিক্রিয়াকে বুঝে থাকি।
আবার, এসিড হিসেবে আমরা যেকোনো তীব্র এসিড নিই না কেন প্রতি ক্ষেত্রে সে হাইড্রোজেন আয়ন H+ সরবারাহ করবে এবং ক্ষার হিসেবে যেকোনো তীব্র ক্ষার নিলে সেটি হাইড্রোক্সাইড OH- সরবরাহ করবে। মোল পানি উৎপন্ন করতে করবে। অতঃপর এরা পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে পানি উৎপন্ন করবে। যে পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হয় তাকে প্রশমন তাপ বলে। হিসাব করে দেখা গেছে, মোল পানি উৎপন্ন করার জন্য 57.34 kj তাপ উৎপন্ন হয়।
2. অধঃক্ষেপণ বিক্রিয়া (Precipitation Reaction):
একই দ্রাবকে দুটি যৌগ মিশ্রিত করলে তারা পরস্পরের সাথে বিক্রিয়া করে যে উৎপাদগুলো উৎপন্ন করে তাদের মধ্যে কোনোটি যদি ঐ দ্রাবকে অদ্রবণীয় বা খুবই কম পরিমাণে দ্রবণীয় হয় তবে তা বিক্রিয়া পাত্রের তলায় কঠিন অবস্থায় তলানি হিসেবে জমা হয়। এ তলানিকে অধঃক্ষেপ (precipitate) বলে বলে যে বিক্রিয়ায় তরল বিক্রিয়াক পদার্থ বিক্রিয়া করে কঠিন উৎপাদে পরিণত হয় তাকে অধঃক্ষেপণ বিক্রিয়া বলে।
যেমন: সোডিয়াম ক্লোরাইডের (NaCl) জলীয় দ্রবণের মধ্যে সিলভার নাইট্রেট (AgNO,) জলীয় দ্রবণ যোগ করলে তাদের মধ্যে বিক্রিয়া ঘটে, ফলে সিলভার ক্লোরাইড (AgCl) এবং সোডিয়াম নাইট্রেট (NaNO₂) উৎপন্ন হয়। পানিতে NaNO, এর দ্রবণীয়তা বেশি। তাই NaNO3, পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। কিন্তু পানিতে AgCl এর দ্রবণীয়তা অত্যন্ত কম বলে তা বিক্রিয়ার পর পাত্রের তলায় অধঃক্ষেপ হিসেবে জমা হয়।
NaCl(aq) + AgNO3(aq) = AgCl(s) + NaNO3 (aq)
সোডিয়াম সালফেট (Na₂SO₄) দ্রবণে বেরিয়াম ক্লোরাইড দ্রবণ যোগ করলে বেরিয়াম সালফেট (BaSO4) ও সোডিয়াম ক্লোরাইড উৎপন্ন করে। বেরিয়াম সালফেট অধঃক্ষিপ্ত হয়।
Na₂SO₄(aq) + BaCl, (aq) = BaS04(s) + 2NaCl(aq)