হাইড্রা(Hydra)
হাইড্রা (সিলেন্টেরাটা বা নিডারিয়া) পর্বের Hydrozoa শ্রেণীর এবং Hydra গণের অধীনে বেশ কয়েকটা প্রজাতি আছে। এদের মধ্যে Hydra vulgaris [H. S. C. শ্রেণীতে পাঠ্য]।
১৭০০ সালে আব্রাহাম টেম্বলে হাইড্রা আবিস্কার করেন।গ্রিক মাইথোলজিতে বর্ণিত বহু মস্তক বিশিষ্ট কাল্পনিক দৈত্য হাইড্রার (Hydra) নামানুসারে লিনিয়াস এর নামকরণ করেন।
প্রজাতিভেদে হাইড্রা একলিঙ্গিক (Hydra oligactis) বা উভয়লিঙ্গিক হয় (Hydra vulgaris)
হাইড্রার শ্রেণি বিন্যাস(classification of hydra)
Phylum : Coelenterata/Cnidaria
Class : Hydrozoa
Order : Hydroida
Family : Hydridae
Genus : Hydra
Species : Hydra vulgaris
স্বভাব ও বাসস্থান
এরা সাধারণত স্রোতহীন স্বাদু পানিতে বাস করে। পুকুর, হ্রদ, বিল, নদী এবং ঝর্ণার পরিষ্কার পানিতে হাইড্রা পাওয়া যায়।
হাইড্রার বাহ্যিক গঠন (External Characters)
Hydra vulgaris এর দেহ নলাকার, লম্বাটে এবং ১-৩ সে. মি. লম্বা। পূর্ণাঙ্গ হাইড্রা ক্ষুদ্র, হালকা হলুদাভ বাদামী বর্ণের পলিপ বিশেষ। একটা পূর্ণাঙ্গ হাইড্রার দেহে নিম্নলিখিত অংশগুলাে পাওয়া যায়। যথাঃ
(ক) মুখছিদ্র ও হাইপােষ্টোম (Mouth and Hypostome)
হাইড্রার নলাকৃতি দেহের সম্মুখ বা উপরের প্রান্তে মুখছিদ্র থাকে। মুখছিদ্রের ঠিক নীচে একটা ছােট ও মােচাকৃতি সংকোচন-প্রসারণশীল অঙ্গ থাকে।একে হাইপােস্টোম (Hypo = নীচে, stoma = মুখ) বলে। হাইপােস্টোমের অগ্রপ্রান্ত মুখছিদ্রকে ধারণ করে।
কাজ: পানির সাথে পরিবেশ থেকে খাদ্য ও অক্সিজেন হাইপােস্টোমে অবস্থিত মুখছিদ্রের মাধ্যমে সিলেন্টেরণে প্রবেশকরে এবং সিলেন্টেরণ থেকে পানির সাথে বর্জ্য পদার্থ এবং CO2 বাইরে বের হয়ে যায়।
(খ) দেহকান্ড (Body)
হাইপােস্টোমের নীচ থেকে দেহের পশ্চাৎ প্রান্তে অবস্থিত পদচাকতি পর্যন্ত নলাকার অংশটি দেহকান্ড (Trunk)। দেহকাণ্ডে নিম্নোক্ত অঙ্গগুলাে দেখা যায় ।
(i) কর্ষিকা (Tentacles) : হাইপােস্টোম এবং দেহকান্ডের সংযােগস্থলে কিছুটা দূরে দূরে ৬-৮ টা।ফাঁপা ও সূত্রাকার কর্ষিকা বৃত্তাকারে সংলগ্ন থাকে। এসব কর্ষিকার মুক্তপ্রান্ত বন্ধ সরু ও ভোঁতা এবং অপরপ্রান্ত দেহগহ্বরে উন্মুক্ত থাকে। কর্ষিকাগুলিও এক্টোডার্ম ও এন্ডােডার্ম নামে দুটো কোষীর স্তর এবং তাদের মধ্যে মেসােগ্লিয়া নামে একটা অকোষীয় স্তর নিয়ে গঠিত। কর্ষিকার মধ্যে কর্ষিকার গহ্বর অবস্থিত।
(ii) মুকুল (Bud): দেহকাণ্ডের সাথে এক বা একাধিক গঠনরত ও পূর্ণাঙ্গ মুকুল সংলগ্ন থাকতে পারে।
কাজঃ মুকুল পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ শিশু হাইড্রায় পরিণত হয়। মুকুল গঠন হাইড্রার স্বাভাবিক অযৌন প্রজনন প্রক্রিয়া।
(iii) জননাঙ্গ বা গােনাড (Gonad): প্রজনন ঋতুতে পূর্ণাঙ্গ হাইড্রার দেহকান্ডের উপরিভাবে এক বা একাধিক মােচাকৃতি শুক্রাশয় (Testes) এবং দেহকান্ডের নীচের দিকে একটা বা দুটো গােলাকার ডিম্বাশয় (Ovary) থাকতে পারে। এদেরকে গােনাড বলে।
কাজঃ শুক্রাশয় ও ডিম্বাশয় শুক্রাণু ও ডিম্বাণু উৎপাদন করে যৌন প্রজননে অংশ নেয় (এগুলাে অস্থায়ী জননাঙ্গ)।
(iv) বৃন্ত (Stalk): পূর্ণাঙ্গ হাইড্রা দেহকান্ডের নিম্নপ্রান্তে নিরেট, সরু ও সঙ্কোচনশীল বৃন্ত থাকে। কাজঃ বৃন্ত দেহকান্ড এবং পদচাকতিকে সংযুক্ত করে।
গ) পাদচাকতি (Basal disc)
দেহকান্ডের নিম্ন বা পচাৎ প্রান্তে চাকতির মত আকৃতিবিশিষ্ট পাদচাকতি বাপদতল থাকে।
কাজঃ
(১) হাইড্রা এর সাহায্যে কোন তলের সাথে লেগে থাকে।
(২) প্রয়ােজন মত পদচাকতি বিমুক্ত করে হাইড্রা বিভিন্ন ধরনের চলন সম্পন্ন করে।
(৩) পাচাকৃতি থেকে নিঃসৃত বুদবুদ হাইড্রাকে ভাসতে এবং গ্রন্থিকোষ নিঃসৃত পিচ্ছিলরস এমিবয়েড চলনে সাহায্য করে।
হাইড্রার বাহ্যিক সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য (External identifying characters)
(১) হাইড্রা দ্বিস্তরী প্রাণী
(২) দেহপ্রাচীরের এক্টোডার্মে নিডােব্লাস্ট কোষ থাকে।
(৩) সিলেন্টেরণ নামক দেহগহ্বর একাধারে পরিপাক ও পরিবহনে অংশ নেয়।
(৪) হাইপােস্টোম ও দেহকান্ডের সংযােগস্থল ৬-১০ কর্ষিকা বৃত্তাকারে সংলগ্ন থাকে।
(৫) হাইড্রার দেহের নিম্নপ্রান্তে বৃন্ত (Stalk) ও পাদচাকতি (Basal disc) আছে।
রুই মাছ
Labeo rohita
শ্রেণিবিন্যাস, স্বভাব, বাসস্থান ও গঠন
রুই মাছ বাংলাদেশ তথা এশিয়া অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের একটি সাধারণ মাছ। এদেরকে মেজর কার্প বলা হয়। কার্প জাতীয় মাছ বলতে সেই সমস্ত মাছকে বোঝায় যাদের অন্তঃকঙ্কাল অস্থি দ্বারা তৈরি মস্তক আঁইশবিহীন এবং অতিরিক্ত শ্বসন অঙ্গবিহীন। আমাদের দেশে রুই অর্থাৎ Labeo rohita মাছের চাহিদা অনেক বেশি।
শ্রেণিবিন্যাসগত অবস্থান (Systemic position)
Phylum : Chordata
Subphylum : Vertebrata
Class : Osteichthyes
Subclass : Actinopterygii
Order : Cypriniformes
Family : Cyprinidae
Genus : Labeo
Species : Labeo rohita
রুই মাছের স্বভাব ও বাসস্থান (Habit & Habitat)
স্বাদু পানির জলাশয় বিশেষ করে পুকুর, হ্রদ, নদী, খাল, বিল, হাওর-বাওর প্রভৃতিতে Labeo rohita পাওয়া যায়। রুই মাছ তৃণভোজী স্বভাবের। দুই থেকে তিন বছর বয়সে এরা যৌন পরিপক্কতা লাভ করে। জুন-জুলাই মাসে প্রবাহমান জলাশয়ে এরা ডিম পাড়ে। হালদা নদী রুই মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে গণ্য। বর্তমানে হ্যাচারী বা মৎস্য খামারে প্রণোদিত প্রজননের মাধ্যমে রুই মাছের বাণিজ্যিক চাষ করা হয়। রুই মাছ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মায়ানমার ও আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে পাওয়া যায়।
রুই মাছের বাহ্যিক গঠন
রুই মাছের দেহ মাকু সদৃশ (Spindle shaped) অর্থাৎ মধ্যভাগ মোটা ও দুই প্রান্ত ক্রমশ সরু, প্রস্থ থেকে উচ্চতা বেশি। চলনের সময় পানির ভিতর গতি বাধাপ্রাপ্ত হয় না বলে এ ধরনের আকৃতিকে স্ট্রিমলাইনড (Streamlined) বলে। দেহের পৃষ্ঠভাগ কালো বর্ণের এবং পার্শ্ব অঙ্কভাগ রূপালি সাদা বর্ণের। পূর্ণাঙ্গ রুই মাছ ১৫-২৫ কেজি ওজন বিশিষ্ট হয়।
রুই মাছের দেহকে মস্তক বা মাথা (Head), ধড় বা দেহকাণ্ড (trunk), লেজ বা পুচ্ছ (tail) এ তিন ভাগে ভাগ করা হয়।
মাথা (Head): দেহের অগ্রপ্রান্ত হতে কানকুয়ার পশ্চাৎ প্রান্ত পর্যন্ত অংশকে মস্তক বলে। উদর থেকে মস্তকের উপরিভাগ বেশি উত্তল। থুঁতনী (snout) ভোঁতা, নিচু, কদাচিত স্ফীত। মুখ নিচের দিকে অবস্থিত, আড়াআড়িভাবে বিস্তৃত। মুখছিদ্রের পিছনে কোনো পাতা (eye lids) নেই, কর্নিয়া স্বচ্ছ চামড়ার আস্তরণ দ্বারা আবৃত থাকে। মুখের উপরের চোয়ালে একজোড়া খাটো ও সরু বার্বেল অবস্থিত। এদেরকে ম্যাক্সিলারি বার্বেল (maxillary barbel) বলে। এরা সংবেদী অঙ্গ হিসেবে কাজ করে। মস্তকের প্রতিপার্শ্বে একটা বৃহৎ ফুলকা প্রকোষ্ঠ থাকে। এতে চিরুনীর ন্যায় চারটি ফুলকা থাকে। ফুলকা প্রকোষ্ঠটি কানকুয়া (operculum) নামে পরিচিত। কানকুয়ার নিচের কিনারায় ব্রাঙ্কিওস্টিগাল (branchiostegal) পর্দা ফুলকা প্রকোষ্ঠের বড় ছিদ্রকে ঢেকে রাখে।
দেহকাণ্ড (Trunk): মস্তক ও লেজের মধ্যবর্তী প্রশস্ত অংশটি দেহকাণ্ড। দেহকাণ্ড অস্থিময় সাইক্লয়েড আঁইশ দ্বারা নিবিড়ভাবে আবৃত থাকে। দেহকাণ্ডের উভয় পার্শ্বে একটি করে পার্শ্ব রেখা (Lateral line) দেহের দৈর্ঘ্য বরাবর লেজ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। দেহকাণ্ডের পৃষ্ঠ দিকে একটি পৃষ্ঠ পাখনা (Dorsal fin) পার্শ্বদিকে কানকুয়ার পিছনে একজোড়া বক্ষ পাখনা (pectoral fin), দেহকাণ্ডের মাঝামাঝি একজোড়া শ্রোণি পাখনা (pelvic fin) ও লেজ সংলগড়ব পায়ু পাখনা (anal fin) থাকে।
দেহকাণ্ডের পিছনের দিকে মধ্যঅঙ্কীয় দিকে তিনটি ছোট ছিদ্র পর পর অবস্থান করে থাকে। ছিদ্রগুলো হলো- পায়ুছিদ্র, জননছিদ্র ও রেচনছিদ্র।
লেজ (Tail): রই মাছের পায়ুর পিছনের অংশকে লেজ বলে। লেজকে পরিবৃত্ত করে পুচ্ছ পাখনা (caudal) থাকে। পুচ্ছ পাখনা হোমোসার্কাল (homocercal) প্রকৃতির অর্থাৎ দুটি সমখণ্ডকে বিভক্ত। পুচ্ছ পাখনাই রুই মাছের একমাত্র চলন অঙ্গ।
আঁইশ (Scale): রুই মাছের দেহত্বক অস্থিময় কতগুলো পাত সদৃশ্য গঠন দ্বারা আবৃত থাকে, এদেরকে আঁইশ বলে। রুই মাছের দেহ সাইক্লয়েড আঁইশ (Cycloid scale) দ্বারা আবৃত থাকে। এগুলো সাধারণত গোলাকার ও রূপালী বর্ণের হয়ে থাকে। আঁইশের কেন্দ্রস্থলে ফোকাস রেখা থাকে। আঁইশের কেন্দ্রস্থলকে ফোকাস বলে। আঁইশের কেন্দ্রকে ঘিরে ঘন সন্নিবিষ্ট কতগুলো রেখা থাকে। এগুলোকে সার্কুলি (circuli) বলে। আঁইশে সার্কুলিগুলোর মাঝে গাঢ় বর্ণের বৃদ্ধি রেখা অর্থাৎ অ্যানুলি (একবচনে অ্যানুলাস) থাকে, যেগুলোর সংখ্যা প্রতিবছর একটি করে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এগুলো গণনা করে মাছের বয়স নির্ধারণ করা হয়। রাসায়নিকভাবে আঁইশগুলো চুন ও কোলাজেন তন্তু নিয়ে গঠিত। এরা চলনের সময় পানির বাধা হ্রাস করে। তাছাড়া শ্রেণিবিন্যাস ও বয়স নির্ণয়ে এরা ভূমিকা রাখে।
রুই মাছের খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস
রুই মাছ শাকাশী। এরা সাধারণত জলাশয়ের মধ্যস্তরে খাবার খায়। ছোট অবস্থায় রুই মাছের প্রধান খাদ্য হচ্ছে Zooplankton এবং বয়স্করা Phytoplankton খেয়ে বাঁচে। রুই মাছের মুখ কিছুটা নিচের দিকে নামানো এবং ঠোঁট পুরু থাকার কারণে মাঝে মাঝে এরা পানির তলদেশ থেকে পঁচা জৈব পদার্থ খেয়ে জীবনধারণ করে। এছাড়া ফিসমিল (Fish meal), খৈলের গুঁড়া, কুঁড়া ইত্যাদি পুকুরে চাষের সময় সম্পূরক খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বয়স্ক রুই মাছ মাঝে মাঝে কাঁদা ও বালি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।